দিল্লি হারাবার পরে মোগল সম্রাট সুন্নী হুমায়ুন গেলেন পারস্য সম্রাটের কাছে; পারস্যের শিয়া সম্রাট সাহায্য করতে রাজি হইলেন; কিন্তু শর্ত দিলেন যে শিয়া হইতে হবে হুমায়ুনকে। রাজি হইলেন না হুমায়ুন; পাল্টা প্রস্তাব দিলেন শিয়া সম্রাটকে; মোগল সাম্রাজ্যে শিয়াদের খাতির-যত্নে রাখবেন, শিয়া ইসলাম প্রচারে বাধা দেবেন না, সাহায্য করবেন। তাতেই খুশি থাকলেন শিয়া পারস্য; ১২০০০ ঘোড়সওয়ার দেবার কথা বলে ১৫০০০ দিলেন। হুমায়ুন তাদের নিয়া দিল্লি উদ্ধার করলেন, পরে কথাও রাখলেন। শিয়ারা ভালো পদ-জায়গীর-সম্মান সবই পাইলেন। হুমায়ুনের পোলা আকবরও সেইটা কন্টিনিউ করলেন। জাহাঙ্গীর করেন নাই আর। তিনি শিয়া ইমামকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। আকবরের প্রধান বিচারপতি (কাজি কুজাজ) কাজি নুরুল্লাহ সুস্থারিকে হত্যা করলেন সম্রাট সুন্নী জাহাঙ্গীর। কাজি নুরুল্লাহ শিয়াদের কাছে পাঁচ শহিদের তৃতীয় জন হিসেবে স্মরণীয়।
সুন্নী সম্রাট আওরঙ্গজেবের এন্টি-শিয়া মুভ মোগল সাম্রাজ্যকেই দুর্বল করে ফেলে। মোগল সাম্রাজ্যের প্রান্তের দিকে শিয়া অভিজাতদের আনুগত্য স্থায়ীভাবেই হারাতে থাকে মোগলরা। এখনকার ইতিহাস আওরঙ্গজেবকে হিন্দু-নির্যাতক বলে দেখায়; কিন্তু তাঁর দরবারে বিপুল হিন্দু অমাত্য ছিলেন, তিনি আসলে খর্ব করেন শিয়াদের প্রাধান্য; সেজন্যই সম্ভবতঃ মোগল দরবারে তিনি হিন্দুর সংখ্যা বাড়াইয়া রাখতেন শিয়াদের তুলনায়। শিয়াদের মহররম নিষিদ্ধ করেন আওরঙ্গজেব; কাশ্মিরের শিয়া গ্রামে আগুন দেন। তারই ফলশ্রুতিতে আমরা মুর্শিদাবাদে আলিবর্দিকে পাই দিল্লির সাথে প্রায় সম্পর্কহীন। আলিবর্দি-সিরাজ-মীর জাফর শিয়া মুসলিম ছিলেন।
তৎকালীন বিরোধগুলিতে অভিজাত-অনভিজাত দ্বন্দ্বও ভূমিকা রাখছিলো পতনে। মায়ের হিন্দু বান্দিকে বিয়া করেন সিরাজ; হিন্দু বান্দি রাজকুনবার সিরাজকে বিয়া করে শিয়া মুসলিম বেগম লুৎফুন্নেসা হইয়া যান। ঘটনা হিন্দু-মুসলিম অভিজাতদের ভালো লাগে নাই নিশ্চই; সিরাজের দুর্নামগুলির বেশিরভাগ অভিজাত শিয়া ইতিহাসবিদদের কাছ থেকে পাওয়া, ইংরেজের লেখা ইতিহাস নয়। অন্ধকূপ হত্যা বাদে সবগুলি দুর্নাম পাওয়া যায় ‘শিয়ার আল-মুতাখেরিন’ ও ‘রিয়াজুস সালাতিন’ নামের দুই বইয়ে–দুই শিয়া ঐতিহাসিকের লেখা। এই বই দুইটাই ইংরেজ ঐতিহাসিকদের সোর্স/রেফারেন্স।
শিয়া মীর জাফর-ঘসেটি এবং উমিচাঁদ-রাজবল্লভদের অভিজাততন্ত্রের কাছেই সিরাজের পরাজয় পলাশিতে। ওদিকে এই শিয়াদের আর বিশ্বাস করে নাই সুন্নী মোগলের দিল্লি; সে কারণেই হয়তো ইংরেজের দেওয়ানী লাভ দিল্লি থেকে।
সাম্প্রদায়িকতা এবং অভিজাততন্ত্রের এই যে ইন্টারসেকশন সেইটা ইতিহাসে গায়েব; অভিজাততন্ত্রী এই উচ্চম্মন্যতা আবার আমরা পাচ্ছি এখন বাংলাদেশে। বিজ্ঞানমনস্ক হুমায়ুন আজাদ আর চোখে অন্ধকার দেখা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘এনলাইটেনমেন্ট’ দাসত্ব-ই বাংলাদেশে এখন উচ্চম্মন্য অভিজাত; আবদুল্লাহ বা জোহরার মুসলিমরা এখন ওয়ালিউল্লাহর ধর্ম ব্যবসায়ী মজিদ বা ধর্মান্ধ মধ্যযুগ। এ এক নতুন সাম্প্রদায়িকতা; এ নতুন মারামারি শিয়া-সুন্নী-মাদ্রাসালিপ্ত-বিজ্ঞানমনস্ক মুসলিম—কারোই কোন উপকার করবে না; দেশের উপকার কি করবে? কোন সম্ভাবনাই নাই।
শিয়া-সুন্নীর সাম্প্রদায়িক রেষারেষির ইতিহাসের আরো বিস্তৃতি আছে। সিরাজ-মীর জাফর দ্বন্দ্ব তখন তখনই শেষ হয় নাই। সিরাজের বউ-মেয়ে পরে ইংরেজের বৃত্তি নিয়া বাঁচে—শিয়া মুসলিম হিসাবেই, হয়তো বান্দির বাচ্চা হিসাবেও। সিরাজেরই উত্তর প্রজন্মের একজন ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রথম বউ। সে আর অত শিয়া ছিলেন না; সুন্নী সুফি ঘরানার সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিয়া হইতে পারছিলো সে কারণেই। ওদিকে সোহরাওয়ার্দীকে ১৯৫৮ সালের পাকিস্তানে ক্ষমতাচ্যূত করেন মীর জাফরের উত্তর প্রজন্ম ইস্কান্দার মীর্জা। আবার, সুন্নী মুসলিম শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী মানতে রাজি হন নাই শিয়া ভুট্টো। শিয়া জেনারেল ইয়াহিয়া খান খুন করলো বাংলার সুন্নী মুসলিমদের, হিন্দুদের।
এসব মারামারিতে কী কী লাভ হইছিলো এনাদের সবার? আজকেও যখন ইরাকে খিলাফত ঘোষণা করলো সুন্নীরা, তাতে বিচলিত হতে হলো শিয়া ইরানকে, খৃস্টান পশ্চিমের যেকোন ইন্ধন বাদেই—একে কিভাবে মুসলিমদের সাফল্য হিসাবে পড়া যাবে ইতিহাসে?
৩ জুলাই ২০১৪
নোট: লুৎফা
হিস্ট্রিক্যল যোগাযোগটা মজার যে, সিরাজদ্দৌলা আর তাহের–দুইজনের বউয়ের নামই লুৎফা, দুই বউই অল্প বয়সে বাচ্চা-কাচ্চা লইয়া বিধবা হইছেন, দুই বউ-ই আর ইন্সটিটিউশনাল সেক্স-লাইফে যান নাই–মানে বিয়া করেন নাই, দুই বউয়ের স্বামীই খুন হইছেন, দুই বউয়ের স্বামীর পলিটিক্যাল ডিফিটই ইতিহাসে বড়সড় এদিকওদিক ডিটারমাইন করায় ভুমিকা রাখছিলো।
সিরাজদ্দৌলার বউ লুৎফুন্নেসা পরবর্তী ইংরাজের অধীন/ইংরাজ সরকারের বৃত্তি নিয়া কলিকাতায় থাকতেন, বাচ্চাদের পড়ালেখা করাইয়া বড় করছিলেন, সেই বাচ্চারা বিয়া-শাদী কইরা বাচ্চা-কাচ্চা জন্ম দিছেন, তাগো একজন আছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির পয়লা বউ; ওদিকে মীর জাফরের বংশধর ইস্কান্দার মীর্জা পূবপুরুষের মতোই সিরাজদ্দৌলার লিগেসিরে উৎখাত করছিল পাকিস্তানের প্রাইম মিনিস্টার সোহরাওয়ার্দীরে সরাইয়া, মীরজাফরের মতোই ইস্কান্দার মীর্জাও সকল পাওয়ার খুয়াইয়া ফেলেন আইউবের কাছে।
এদিকে লুৎফা তাহের পরে একটা সরকারি চাকরি শুরু করেন বলছেন ইন্টারভিউতে; জিয়া সরকারের দিতে চাওয়া সুবিধা নেন নাই বলেই বলছেন এইখানে। এইভাবে ভাবলেই আরাম বেশি বটে। তবে, জিয়া সরকারের সময়ে লুৎফা তাহের সরকারি চাকরি পাইছেন সেইটা জিয়ার অজান্তে বা জিয়ার সরাসরি চাওয়ার বাইরে ঘটতাছে সেইটা কেমনে ভাবা যায়! লুৎফা কইতাছেনও যে, বাসার সামনে গোয়েন্দারা থাকতো সব সময়! সরকারি চাকরির লগে সরকারি কোয়ার্টারও। ইন্টারভিউ মোতাবেক জিয়া সরকার আরো আরো হেল্প/বৃত্তি দিতে চাইছিল, তা আর নেন নাই লুৎফা তাহের। মনে হচ্ছে, লুৎফা তাহের একটা কাভারের ভিতর দিয়াই সরকারি সাহায্য নিতে রাজি হইছেন, লুৎফুন্নেসার মতো সরাসরি নিতে রাজি হন নাই। লুৎফুন্নেসার টাইমে অমন কাভার পসিবলও আছিল না বটে, মানে তখন মেয়েদের সরকারি চাকরি তো অ্যাবসার্ড ব্যাপার একটা!
আমাদের মনে হইতে পারে যে, লুৎফা তাহের এইভাবে নিজের ও তাহেরের অনার বাঁচাইলেন, লুৎফুন্নেসা যেইটা করেন নাই। আমি অবশ্য, ওনাদের ক্ষতিই বেশি দেখতেছি।
তাহেরের পলিটিক্যাল শত্রু আওয়ামী লীগের ভিতরেই এখন বসবাস তাহের ফেমিলি বা জাসদের, সেই আওয়ামী সিকিউরিটি লইয়া জিয়ারে দুইটা গালি দিতে পারলেই এনাদের আরামের পুরাটা পাইয়া যাইতাছেন। কিন্তু সিরাজের বউ লুৎফুন্নেসা যেমনি একভাবে স্বামীর ফাইটটা কন্টিনিউ করার ব্যবস্থা করতে পারছিলেন শত্রুর বৃত্তি লইয়াই, সিরাজের লিগেসিরে পাওয়ারের সেন্টারের কাছাকাছি রাখতে পারছিলেন লুৎফুন্নেসা, বৃত্তি নিতে কাভার ইউজ করতে যাইয়া লুৎফা তাহের সেইটা আর পারেন নাই; তাহেরের লিগেসি দেশের পলিটিক্যাল পাওয়ারের সেন্টারে বিশেস কোন মিনিং দেয় না আর।
এইজন্য জাসদ মনে হয় আরো বেশি দায়ী; ওইভাবে নেতা খুন হইলে তার পলিটিক্যাল পার্টি সেইটারে ক্যাপিটালাইজ করে, আরো বড় হইতে থাকে, জাসদ সেইটা আদৌ পারে নাই। পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ যেমন জেল-জুলুমের ভিতর দিয়া বড় হইছে জাসদের বেলাতেও সেইটা হইতে পারতো, বাট জাসদ হাসিনার ‘পাকা বাম’-এর বেশি কিছু হইতে পারে নাই।
—————————
“ইব্রাহিম সাহেব তখন পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। সে সময় সেখানে কিছু অফিসার নেওয়া হচ্ছিল। ইব্রাহিম সাহেব বললেন, “ওকে আবেদন করতে বলুন।” আমার তখন বয়স ছিল, যোগ্যতা ছিল। চাকরিটা হয়ে গেল। ৩৭৫ টাকা স্কেলে চাকরিতে ঢুকলাম। বেশ কিছুদিন পর মোহাম্মদপুরের আজম রোডে একটি সরকারি কোয়ার্টার পেলাম। ছোট্ট মিশু থাকল আমার মায়ের কাছে। অফিসের বাসেই যাওয়া-আসা করতাম।’
‘সরকার থেকে কোনো রকম সাহায্য করা হয়নি?’‘সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু আমি কখনোই তা নিইনি। একবার জেনারেল মঞ্জুর এসে বললেন, “ভাবি, আপনি কেন এ রকম বাসায় থাকবেন? দাবি করলেই তো ভালো বাড়ি পেতে পারেন।” বললাম, “আমি তো দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি কর্মচারী। সে রকমই বাসা।” সরকারিভাবে কখনো কখনো বিদেশে দূতাবাসে চাকরি দিতে চেয়েছে। একবার ১০ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছিল আমার জন্য। কিন্তু আমি এসব কিছুই গ্রহণ করিনি। নিজের যোগ্যতায় যা পারব, তা-ই করব বলে স্থির করেছি।/লুৎফা তাহেরের ইন্টারভিউ থেকে (http://www.bangarashtra.net/article/582.html)”